মানসিক রোগ থেকে মুক্তির সহজ উপায়

মানসিক রোগ থেকে মুক্তির উপায় – রোগ শুধু শরীরের না মনেরও। কী নিয়ে কথা বলছি, আশা করি বুঝেছেন। হ্যা,মানসিক রোগ। আমাদের সমাজের একটা বিশাল অংশ এখনো মানসিক রোগ সম্বন্ধে সচেতন না। একটা স্বাভাবিক জীবনযাপন এর জন্যে শারীরিক সুস্থতা যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনই প্রয়োজন মানসিক সুস্থতা।


মানসিক রোগ কি?

জিন ও ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার জটিল পারষ্পরিক ক্রিয়ার ফলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ও কর্মক্ষমতার বিপর্যয়ই মানসিক রোগ। মানসিক রোগের কারন গুলো প্রায়ই অস্পষ্ট। মানসিক রোগ সাধারনত একজন ব্যাক্তির আচরণ, মতানৈক্য এবং অনুভূতির সমন্বয় দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়।তাই মানসিক রোগ নির্নয়ের ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সামাজিক নিয়মগুলো মাথায় রাখতে হয়।


বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মানসিক রোগে ভোগে।এর পিছনে যে সাধারণ কারন গুলো রয়েছে সেগুলো হলো, দারিদ্র্যতা,পারিবারিক অশান্তি, কর্মসংস্থান ও ধর্মীয় অনুশাসনের অভাব।


এছাড়া অনেক শারীরিক রোগের প্রভাবে মানসিক রোগ হতে পারে।যেমনঃ মৃগীরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিকস,ব্রেইন টিউমার,হার্ট ফেইলিউরের ফলেও মানসিক রোগ হতে পারে। ( মানসিক রোগ থেকে মুক্তির সহজ উপায় )


মানসিক রোগ নিরাময়ের বাধাসমূহ কি ?


 চিকিৎসা সম্পর্কে ভূল ধারণাঃ


আমাদের দেশে বেশ কিছুদিন আগেও মানসিক হাসপাতালকে পাগলাগারদ বলা হত।এটি প্রমান করে মানসিক রোগ সম্মন্ধে আমরা কতটুকু সচেতন।

এছাড়া মানসিক রোগের পথ্য নিয়ে আছে ভুলধারনা।অনেকে মনে করেন শুধুমাত্র কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে মানসিক রোগের চিকিৎসা করা হয়।

এছাড়া অনেকে না জেনে ওষুধের পার্শপ্রতিক্রিয়া নিয়ে কথা বলে।যা মানসিক রোগের চিকিৎসা নেয়া থেকে অনেককে বিরত করে।


রোগ নির্নয়ে সমস্যাঃ

আমাদের সমাজ এখনও কুসংস্কার আচ্ছন্ন।কারও আচরণগত কোন সমস্যা দেখা দিলে সেটাকে ভূত বা জিনের আছর বলে মেনে নেয়। যার ফলে মানসিক রোগ যে আছে এই ব্যাপারটাকেই উপেক্ষা করা হয়।



মানসিক রোগের চিকিৎসা কি ?

সাইকোসিস তথা গুরুতর মানসিক রোগের ক্ষেত্রে ওষুধ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।ওষুধের পাশাপাশি কাউন্সেলিং চলিয়ে যেতে হয়।কিছুক্ষেত্রে এই চিকিৎসা আজীবন চালিয়ে যেতে হয়।


নিউরোটিক তথা কম গুরুতর মানসিক রোগের ক্ষেত্রে কাউন্সেলিং খুব কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি। এছাড়া মানসিক রোগে আক্রান্ত এমন মানুষকে একটা ভালো জীবনযাপনের সুযোগ দিলে, আরোগ্য লাভ অনেক কম সময়সাপেক্ষ হয়।


লেখেছেনঃ সায়মা রাহমাআরো পড়ুন-মস্তিষ্কের জন্যে ক্ষতিকর অভ্যাস গুলো দূর করে নিজেকে পরিবর্তন করার উপায়।(মানসিক রোগ থেকে মুক্তির সহজ উপায়)


১. পরিস্থিতি দেখে পলায়নপর হবেন না কিংবা এড়িয়ে যাবেন না

আমরা সাধারণত যেকোনো ধরনের বেদনাদায়ক ও কষ্টদায়ক উদ্দীপক এবং পরিবেশ থেকে মুক্তি চাই কিংবা এড়িয়ে যেতে চাই। পলায়নপর এই প্রবণতা অনেক সময় নেতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে। কারণ, বাস্তবতা যতই প্রতিকূল হোক না কেন, তাকে অস্বীকার করে সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। 

বরং উল্টো বিভিন্ন মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। তাই বর্তমান করোনা সংকটকে এড়িয়ে না গিয়ে বরং চলমান জীবনের একটা অংশ হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে প্রথমেই। সেখান থেকে একটি ইতিবাচক অর্থ তৈরি করার মাধ্যমে আমরা মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারি।


২. নিজের অক্ষমতা স্বীকার করুন

এই সময় মনের মধ্যে বিপর্যয়মূলক বিভিন্ন চিন্তা আসতে পারে। যেমন: প্রিয় মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কি না, চাকরি চলে যাবে কি না, পরিবার ও আত্মীয়স্বজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে কি না। 

বিপর্যয়মূলক চিন্তা এলে সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে এটাও চিন্তা করতে হবে যে আমাদের জীবনের সবকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। সুতরাং এই অক্ষমতাটুকু অকপটে স্বীকার করে বিপর্যয়মূলক চিন্তাগুলোকে বাধা না দিয়ে বরং পরিবর্তনের স্বাভাবিক ইঙ্গিত হিসেবে সম্মান করার চেষ্টা করুন। এতে প্রিয় ও অপ্রিয় সবকিছুকে সাদরে গ্রহণ করার ক্ষমতা বাড়বে। একসময় দেখবেন বিপর্যয়মূলক চিন্তাগুলো আপনার মনের ভেতর বারবার ঘুরপাক খাওয়া নিজ থেকেই বন্ধ করে দেবে।


৩. কোনো ধরনের আবেগকে নিজের আত্মপরিচয়ের অংশ মনে করবেন না

অনিশ্চয়তার কারণে আমাদের মধ্যে ভয়, উদ্বিগ্নতা কাজ করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সব ভয় ও উদ্বিগ্নতাকে নিজের ব্যক্তিত্বের এবং আত্মপরিচয়ের অংশ মনে করবেন না। অর্থাৎ, বিদ্যমান ভয় ও উদ্বিগ্নতা মানেই আপনি নন। (মানসিক রোগ থেকে মুক্তির সহজ উপায়)

এই ধরনের ভয় ও উদ্বিগ্নতা হলো পূর্ব অভিজ্ঞতাবিহীন ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির প্রতি আপনার শরীর ও মনের স্বয়ংক্রিয়, ক্ষণস্থায়ী ও স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তাই এগুলোকে মন থেকে দূর করার চেষ্টা না করে শান্তভাবে মেনে নিতে হবে এবং সেগুলোর ওপর কোনো ধরনের ব্যক্তিগত অর্থ আরোপ না করে নিজেকে আনন্দদায়ক বা বাড়ির দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। এতে বিদ্যমান ভয় ও উদ্বিগ্নতার প্রভাব ধীরে ধীরে কমে যাবে।


৪. অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমান নিয়ে ভাবুন

মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর আরেকটি কার্যকর উপায় হলো নিজের মনকে অতীত ও ভবিষ্যতের দিকে না পাঠিয়ে বর্তমানের চলমান মুহূর্তের ভেতর ধরে রাখার চেষ্টা করা। এটা একটু কঠিন। কারণ, আমাদের মন সব সময় অতীত চিন্তা ও কিছুক্ষণ ভবিষ্যৎ চিন্তার ভেতর লাফালাফি করে। (মানসিক রোগ থেকে মুক্তির সহজ উপায়)

মন যখন অতীতের কোনো বিষয়ের প্রতি বেশি একাত্ম হয়ে যায়, তখন আমাদের ভেতর বিষণ্নতা তৈরি হয়। আর যখন ভবিষ্যতের প্রতি বেশি একাত্ম হয়ে যায়, তখন আমাদের ভেতর উদ্বিগ্নতা তৈরি হয়। 

মাত্রাতিরিক্ত অতীত ও ভবিষ্যতের চিন্তা অপরাধ বোধ ও আতঙ্ক তৈরি করে। তাই মানসিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমাদের মনকে সব সময় আমাদের দেহের ভেতর রাখতে হবে। কারণ, আমাদের দেহ সব সময় বর্তমানেই বাস করে।


৫. পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন

সঠিক সময়ে দৈনিক কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, পর্যাপ্ত ঘুম মানসিক ও শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। নিয়মিত স্নান করা, নিজের কাপড়চোপড় নিজে ধোয়া, নিজের রুম নিজে পরিষ্কার করার অভ্যাস করতে হবে। বাড়ির কাজে অন্যকে সাহায্য করতে হবে, যা আপনার একটি দিনকে অর্থপূর্ণ করতে সাহায্য করবে। 

সেই সঙ্গে প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় পুষ্টিকর খাবার ও দেশি ফলমূল নিশ্চিত করতে হবে এবং অল্প সময়ের জন্য হলেও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।


সব শেষে নিজের প্রতি, ভবিষ্যতের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অনুশীলন করতে হবে। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ ও প্রকৃতিকে বন্ধু বলে মেনে নিতে হবে।


৬. স্বজনদের সঙ্গে অকৃত্রিম বন্ধন তৈরি করুন

পরিবারের সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া–প্রতিবেশীর সঙ্গে অকৃত্রিম বন্ধন তৈরি করা এবং বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ইতিবাচক সম্পর্ক মনকে সব সময় সতেজ রাখে এবং মনের পজিটিভ এনার্জি বাড়িয়ে দেয়।(মানসিক রোগ থেকে মুক্তির সহজ উপায়)


যতটুকু সম্ভব মানুষকে আন্তরিকভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করতে হবে। এতে মানুষের সঙ্গে মানুষের একাত্মতা বাড়ে। একাত্মতা মানুষের একাকিত্বের অনুভূতি দূর করতে সাহায্য করে।


৭. সৃজনশীল হোন

প্রতিদিন ছোটখাটো কোনো সৃজনশীল কাজ করার চেষ্টা করতে হবে। এতে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। পারিপার্শ্বিক চাপ মোকাবিলার কৌশল হিসেবে কোনো ধরনের মাদকদ্রব্য ও মাত্রাতিরিক্ত চা-কফি পান করা যাবে না। যেসব বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে চাপ তৈরি হচ্ছে, সেই সব উৎসকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চিহ্নিত করতে হবে। 

মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী যেসব উপাদান বর্তমানে মোকাবিলা করা সম্ভব, সেগুলোকে যৌক্তিক মন দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। আর যেসব উপাদানকে আপাতত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, সেগুলো চিন্তার তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে এবং এড়িয়ে চলতে হবে। এতে আপনার আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়বে।





Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url