মানুষ মরে গেলে পচে যায় বেঁচে থাকলে বদলায় --মুনীর চৌধুরী
আমাদের মধ্যে হয়ত বা অনেকেই এই উক্তিটা শোনেছে যে মানুষ মরে গেলে পচে যায় বেঁচে থাকলে বদলায়।
"মানুষ মরে গেলে পচে যায় , বেঁচে থাকলে বদলায় , কারণে অকারণে বদলায় ।"-- মুনীর চৌধুরী || রক্তাক্ত প্রান্তর
মানুষ মরে গেলে পচে যায় বেঁচে থাকলে বদলায়,কারণে-অকারণে বদলায়
আমরা জানি এই উক্তির সঙ্গে এখনো পরিচিত নন এমন বাঙালি আর খুঁজে পাওয়া মনে হয় কষ্টই বটে! আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের পটভূমিতে তৈরি মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকের বিখ্যাত এটি একটি সংলাপ । চিরাচরিত মানুষের এক বাস্তবতা তুলে ধরেছিলেন মাত্র এই একটি লাইনেই। আজ এই নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক,গুণী শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, বাগ্মী এবং বুদ্ধিজীবীর জন্মদিন।
গুগল ডুডলে গায়ে চাদর জড়িয়ে বই হাতে দেখা যাচ্ছে আমাদের মুনীর চৌধুরীকে। তার পৈতৃক নিবাস নোয়াখালী জেলার চাটখিল থানাধীন গোপাইরবাগ গ্রামে।আমাদের আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী ২৭ নভেম্বর ১৯২৫ সালে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। ইংরেজ আমলের একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর আবদুল হালিম চৌধুরীর চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় ছেলে।
মুনীর চৌধুরী ১৯৪১ সালে (বর্তমান ঢাকা কলেজ) ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় এবং ১৯৪৩ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে আইএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স (১৯৪৭) এবং অনার্স (১৯৪৬) পাস করেন, উভয় ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় শ্রেণীতে। তিনি ছিলেন সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক একজন ছাত্র।
মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকের বিখ্যাত একটি উক্তি হলো মানুষ মরে গেলে পচে যায় বেঁচে থাকলে বদলায়,কারণে-অকারণে বদলায়। এটা অনেক কিছু মানষকে বোঝায়। ১৯৪৬ সালে নিখিল বঙ্গ সাহিত্য প্রতিযোগিতায় সর্বাধিক সংখ্যক পুরস্কার জিতেছিলেন। ছাত্রাবস্থাতেই এক অঙ্কের নাটক রাজার জন্মদিনে লিখেছিলেন, যা ছাত্র সংসদ মঞ্চস্থ করেছিল সেসময়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই মুনীর চৌধুরী বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, ফলে তার পরীক্ষার ফলাফল এতে অনেক ব্যাহত হয়। বামপন্থী রাজনীতিতে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ততার কারণে তাকে সলিমুল্লাহ হল থেকে বহিস্কার করা হয়। একই কারণে পিতার আর্থিক সাহায্য থেকেও তিনি বঞ্চিত হন। এসময় তিনি ঢাকা বেতার কেন্দ্রের জন্য নাটক লিখে আয় করতেন। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যে প্রথম ছাত্রসভা হয়, তাতে তিনি বক্তৃতা করেন।
আরো পড়ুন: আমাদের শরীরের তাপমাত্রা ৯৮.৬ ডিগ্রি
মুনীর চৌধুরী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান সরকারের হাতে বন্দী হন। বন্দী থাকা অবস্থায় তিনি তার বিখ্যাত নাটক কবর রচনা করেন ১৯৫৩ সালে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের যে কোনো ধরনের সংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। ১৯৬৬ সালে রেডিও ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান প্রচারে পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদ করেন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার বাংলা বর্ণমালাকে রোমান বর্ণমালা দিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে সে আন্দোলনের সমর্থনে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব বর্জন করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরপরই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির অধীনে পূর্ববঙ্গে (নববগঠিত পূর্ব পাকিস্তান) কাজকর্ম পরিচালনার জন্য একটি আঞ্চলিক (জোনাল) কমিটি গঠন করা হয়। এই জোনাল কমিটির সাত সদস্যের একজন ছিলেন মুনীর চৌধুরী। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে মুনীর চৌধুরী যোগদান করেন। একই বছরের শেষের দিকে প্রগতি লেখক সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন।
মুনীর চৌধুরী ১৯৫৩ সালে কারাবন্দী অবস্থায় কবর নাটকটি রচনা করেন। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত পূর্ববঙ্গ সরকারের ভাষা-সংস্কার কমিটির রিপোর্টের অবৈজ্ঞানিক ও সাম্প্রদায়িক বিষয়বস্তুর তীব্র সমালোচনা করে মুনীর চৌধুরী পূর্ববঙ্গের ভাষা কমিটির রিপোর্ট আলোচনা প্রসঙ্গে একটি দীর্ঘ ভাষাতাত্ত্বিক প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৫৯ সালের ২৭শে এপ্রিল প্রবন্ধটি বাংলা একাডেমিতে পঠিত হয়। কিন্তু মুসলিম ধর্মবিশ্বাসে আঘাতের অভিযোগে সামরিক সরকারের কাছে তাকে কৈফিয়ৎ দিতে হয়।
আরো পড়ুন:ছাপাখানা মেশিনের দাম
এরপর তিনি সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন ও বেশ কিছু অনুবাদ ও মৌলিক নাটক লেখেন। অনেকগুলো প্রবন্ধের সংকলনও প্রকাশ করেন। মীর মানস প্রবন্ধ সংকলনের জন্য দাউদ পুরস্কার ১৯৬৫ সালে এবং পাক-ভারত যুদ্ধ সম্পর্কে লেখা সাংবাদিকতাসুলভ রচনা-সংকলন রণাঙ্গন এর জন্য ১৯৬৬ সালে সিতারা-ই-ইমতিয়াজ উপাধি লাভ করেন। ১৯৬৭-৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বাংলা বর্ণমালা ও বানান-পদ্ধতির সংস্কার প্রচেষ্টার প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে প্রবন্ধ লেখেন এবং পরবর্তীতে এ বিষয়ক বিতর্কে সক্রিয় অংশ নেন।
১৯৭১ সালের মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুনীর চৌধুরী ফিরে আসার কিছুকাল পরেই শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। তার সেই কিশোর ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চলে যায়। এসময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আদেশে মে-জুন মাসে ইংরেজি বিভাগের প্রধান হিসেবে এবং জুলাই মাস থেকে কলা অনুষদের ডীন হিসেবে কাজ করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর মুনীর চৌধুরীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের সহযোগী আল-বদর বাহিনী তার বাবার বাড়ি থেকে অপহরণ করে ও সম্ভবত ঐদিনই তাকে হত্যা করে।